নেমেসিস নাজিম উদ্দিন Pdf – nemesis nazimuddin pdf download

বই: নেমেসিস মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
প্রচ্ছদ: সিরাজুল ইসলাম নিউটন
জনরা: থ্রিলার বই Pdf Download
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১০
(সংস্করণ: দশম (জুলাই ২০১৮)
আলোচনা:
পরবর্তী সংস্করণগুলোর গ্রন্থস্বত্ত্ব আর উৎসর্গ পাতার মাঝে অতিরিক্ত একটি পাতা পাওয়া যায়, নেমেসিসে’র লেখক কিছুটা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যেখানে লিখেছেন, “[ব]লতে গেলে নিঃসঙ্গভাবেই মৌলিক থৃলারের এ যাত্রাটি শুরু করেছি(লেন)”[1]— এই নিঃসঙ্গ যাত্রীর পরবর্তী ইতিহাস আমাদের জানা, ক্রমে ক্রমে ছ’খন্ডে বেরিয়েছে তার যাত্রার ইতিবৃত্ত; কিন্তু তারপরও ঐ আদিখন্ডে, খোদ লেখকও যেটা “[লে]খার সময় ঘুণাক্ষরে ভা(বেন) নি এটাকে সিরিজ হিসেবে”[2] লিখবেন, প্রকাশনার এক দশক পরও আমাদের বারংবার দৃষ্টি ফেরাতে হয়, কারণ এখানে কাহিনীর অনুসঙ্গ, অর্থাৎ চরিত্র, আবহ (milieu), মেজাজ (tone), পালা (plot)-কে যতটা প্রাথমিক রূপে পাই, পরবর্তীতে আর সেভাবে পাই না, যেহেতু লেখকের পরিণত হাতের ছোঁয়ায় এরা আরো নিঁখুত ও বিমূর্তভাবে উপস্থাপিত হতে থাকে। কিন্তু এই দশকপূর্তি পূনর্বিবেচনার শুরুতেই একটা প্রশ্নটি অবধারিতভাবেই হাজির হয়: আমরা কি এক দশক পূর্বের পাঠকের জবান দিয়ে আলোচনা করবো না কি গত এক দশক যাবৎ বাংলা মৌলিক থ্রিলার বা রোমাঞ্চ পাঠের তালিম নেয়া একজন পরিণত পাঠকের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করবো? প্রশ্নটির উত্তর কেবল এই টুকরো লেখাটির গতিপ্রকৃতিই ঠিক করে দেবে না, সাথে সাথে আলোচ্য বই, অর্থাৎ মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনে’র নেমেসিস সম্পৃক্ত বিবেচনার অনেক জট-ও আলগা করে দেবে।
প্রশ্নটির উত্তর দু’টি প্রসঙ্গের উপর নির্ভর করছে,⸻ প্রথমত, বর্তমান টুকরোটি কাদের উদ্দেশ্যে লিখিত হচ্ছে? দ্বিতীয়ত, গত দশ বৎসর থ্রিলার পাঠকদের রুচিতে আসলে কতখানি পার্থক্য গড়ে দিয়েছে? পয়লা প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই বর্তমান দশকে’র পাঠকদের উপলক্ষে রেখে; দোসরা, ফেব্রুয়ারি, ‘১০-এ যখন নেমেসিস প্রকাশিত হচ্ছে, তখন তাকে বদস্তুর আন্তর্জাতিক মানের রোমাঞ্চ সাহিত্যের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে স্থানীয় বাজারে, যেহেতু তদপূর্ববর্তী পাঠকরা প্রায় একদশক যাবৎ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের থ্রিলারের অনুবাদ প’ড়ে নিজেদের একটি পাঠ্যরুচি দাঁড় করিয়ে ফেলেছে— দোসরা মাসায়েলের জবাব খতম করার আগে তাই আমরা এই অনুসিদ্ধান্ত না টেনে পারি না, বাংলা রোমাঞ্চ তার আত্মপ্রকাশের শুরু থেকেই দেশের বাজারে নিজের বৈশ্বিক প্রতিরূপের সাথে নিয়মিত টক্কর দিয়ে প্রায় পুরো জনরা ধরেই একরকম বিদেশের বাজারে যাত্রা করেছে এবং রীতিমতো সফল-ও হয়েছে, যেখানে মূল ধারার বাংলা সাহিত্যের এক-দু’জন লেখক ওপারে গেলেও এরকম ঝাঁক ধরে কখনো সীমান্ত পার হতে পারেননি— যাই হোক, এতটুকু নিঃসন্দেহে বলাই যাই, গত এক দশকে এদেশের থ্রিলার পাঠকদের রুচি’র খুব বেশি উন্নতির জায়গা আসলে ছিল না, বরং সেখানে নতুন একটি স্বাদ যুক্ত হয়েছে মাত্র, যাকে আমরা মৌলিক থ্রিলার বা বাংলা রোমাঞ্চ নাম দিয়েছি। তাই আমাদের উচিত হবে, একজন বৈশ্বিক পাঠকের বোধ দিয়ে বইটির আলোচনার চেষ্টা করা, কিন্তু গত এক দশকের বাংলা রোমাঞ্চের দ্বিতীয় ঢেউ-এর উত্থান সম্পর্কে সচেতন থেকে।
খোদ লেখক যখন বইটিকে ‘থৃলার’ হিসেবে দাবি করেছেন, তখন বইটি কতটুকু বিশুদ্ধ রোমাঞ্চ বা থ্রিলার এবং কতটুকু উপন্যাস, সে বিতর্কটি গৌণ হয়ে যায়; কিন্তু তারপরও উপন্যাসের সহজ সংজ্ঞা: বিশদগদ্যোপাখ্যান— মোতাবেক বইটি তিনি লিখতে উপন্যাসের খোলস-ই ব্যবহার করেছেন, তাই একে রোমাঞ্চোপন্যাস হিসেবে সাব্যস্ত করে মূল আলোচনার সূত্রপাত করাই সম্ভবত সমীচীন। রোমাঞ্চোপন্যাসটির সূচনা রোমাঞ্চের বহুলচর্চিত ছকে অপরাধ দিয়েই হয়েছে, একজন স্বনামধন্য লেখকের খুনের মাধ্যমে; আবর্তিত হয়েছে এর খলচরিত্রদের ক্রিয়া ও পরিচয় উৎঘাটনকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ অপরাধের শিকারকে তার প্রাপ্য বিচার দেয়া তথা ইনসাফ প্রতিষ্ঠার তাড়নাকে লক্ষ্যে রেখে; এবং নায়কোচিত এবং সহায়ক চরিত্রদের সাথে খলচরিত্রদের মিথস্ক্রিয়া পালাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে পরিণতির দিকে, রোমাঞ্চের চিরাচরিত ব্যকরণ মেনেই। কিন্তু এই বাঁধা-ধরা ছকে দেখতে গেলে, নেমেসিসে’র সাফল্য সম্পূর্ণটা ধরা পড়ে না। যদি চরিত্রদের ক্রমবিকাশ বিবেচনায় নেয়া হয়, তবে লক্ষ্য করা যাবে, সমগ্র বইয়ের সবচেয়ে বিকশিত চরিত্র জেফরি বেগ, যার নামের অদ্যাক্ষর আমাদের জেমস বন্ডে’র নামের অদ্যাক্ষরকেই স্মরণ করিয়ে দেয়, কিন্তু বেগ কোনো গুপ্তচর নন, গোয়েন্দাও নন, তিনি একজন ইনভেস্টিগেটর, বা তদন্তকারি; কিন্তু পুরো বইজুড়ে কি তিনি কেবল তদন্ত(তৎ+অন্ত)-ই করেছেন? না, বরং তার(তৎ), অর্থাৎ খুনের রহস্যের শেষ(অন্ত) করতে গিয়েই গল্পের ছলে আমরা ঢুকে পড়ি ইতিহাসের কানাগলিতে, বেগে’র অতীতের সন্ধানে— একটি চরিত্রের প্রতি পাঠক ঠিক কখন অনুরক্তি অনুভব করতে শুরু করেন? সম্ভবত যখন তার মাঝে নিজের পরিচিত ইতিহাসের সন্ধান পান। কিন্তু প্রধান চরিত্রের এই অতিবিকাশে আড়ালে চলে যায় অল্পবিকশিত চরিত্রদের খুঁতগুলো। নেমেসিসে’র সব নারী চরিত্ররা সরলরৈখিক, এবং তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য—তারা আবেদনময়ী; এক-দু’জন আবেদনময়ী চরিত্র গুপ্তচরকেন্দ্রিক উপন্যাসে সবসময়-ই থাকে, প্রধান চরিত্রকে (এবং পাঠকের মনোযোগ-কেও) বিভ্রান্ত করার জন্য, যেন কোনো অপরাধ সংঘটন হলেই সেখানে কমসে-কম একজন আবেদনময়ীর উপস্থিতি থাকতে হবে, (ফরাসি প্রবাদ ধার করে বললে, Cherchez la femme,) যারা উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রদের কেবল ছলনায় ভুলিয়ে রাখার জন্যই যেন উপন্যাসে জায়গা পান! নেমেসিসে একরকম এদের ছড়াছড়ি। উপন্যাসের নারীচরিত্রদের উপস্থাপনকে প্রতিনিধিত্বমুলক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে রাজনৈতিক প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। উপন্যাসের খলচরিত্ররা নিয়মমাফিক ধর্ষকামী; কিন্তু মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনে’র সাফল্য হল, তিনি পাঠকের মনে তাদের প্রতি সহানুভূতি জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। উপন্যাসের প্রধান খলচরিত্রে’র মাঝে আমরা তার অপরাধী স্বত্ত্বাকে অতিক্রম করে একজন প্রতিশোধপরায়ণ পিতাকে আবিষ্কার করি,— এই যে একটি চরিত্রের দুটি পরিচয়, বিকাশের দু’টি স্তর, এটাই সম্ভবত একটি সুবিকাশিত চরিত্রের একটি অন্যতম লক্ষণ, যা তাকে অন্য সব সরলরৈখিক চরিত্রদের থেকে আলাদা করে।
সমগ্র বইটি প্রথম পুরুষে বর্ণিত,— প্রথম পুরুষে লেখা উপন্যাসে লেখক প্রায় একজন সবজান্তার ভূমিকা নিয়ে কাহিনীর বর্ণনা করার ক্ষমতা রাখেন; কিন্তু প্রায় সমগ্র বই পাঠক আসলে অন্ধকারে থাকেন, চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়ন নিয়ে,— কেবল তখনই তাদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে অনুমান করা যায়, যখন কোনো পরিস্থিতিতে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়— এভাবে বিবেচনা করতে গেলে বলতেই হবে, প্রথম পুরুষের কথকের উপন্যাসের নির্মিতি’র জন্য যতগুলো অস্ত্র থাকে তার অনেক কিছুই তেমন ব্যবহার করা হয় নি; লেখকের বইটিকে উপন্যাস দাবি না করে থ্রিলার দাবি করার সম্ভবত এটাও একটি কারণ। কয়েকবার কৌশল হিসেবে পালাবদল (plot-twist) ব্যবহার করা হয়েছে; খুব সফলভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে,— একটিবারের জন্যও কোনোটিকে গল্পের সাথে বেখাপ্পা মনে হয় না। প্রধান চরিত্র একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর হলেও, আমরা তার পেশাদারি পরিভাষাগুলোকে তেমন একটা কখনো ব্যবহার করতে দেখি না কথোপকথনে; একটি তদন্তের যে জটিল প্রশাসনিক এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তা নিয়ে পাঠক আঁচ-ও করতে পারে না; একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটরের অফিসের পরিবেশ বা অবস্থান সম্পর্কে একটুও ওয়াকিবহাল হই না আমরা। যদিও এই গৌন বিষয়গুলো কেবল খুঁতখুঁতে পাঠকদের-ই নজরে আসবে; কারণ এরা এমনই: যত খায়, ততই ক্ষুধা পায়!
একজন লেখকের খুন দিয়ে বইয়ের শুরু; প্রতীকিভাবে দেখলে এই খুন, কোনো যে-সে লেখকের খুন নয়, একরকম একজন মূলধারার সাহিত্যিকের খুন—তথা মূল ধারা সাহিত্যকে রীতিমতো বাজারে পাঙ্গার আহ্বান জানানো। রূপকার্থে এমন দাবি করাই যায়, একদশক আগের প্রেক্ষাপটে, নেমেসিস একটা বিদ্রোহ ছিল, বাংলাদেশের বইয়ের বাজারে প্রচলিত তথাকথিত জনপ্রিয় সাহিত্যের বিরুদ্ধে, ছায়াবলম্বিত বাজারে-লেখার বিরুদ্ধে, নাকউঁচু প্রকাশকদের বিরুদ্ধে। গত এক দশকে এই বিদ্রোহ সফল হওয়ার পর-ও নিজের যাত্রা অব্যাহত রেখেছে, এবং দিনে দিনে আরো শক্তি সঞ্চার করছে, তরুণ লেখকদের বিকাশের সবচেয়ে উর্বর জমিন তৈরি করে। আর এই সবকিছুর সুচনা হয়েছিল নেমেসিস দিয়ে; যত-ই খুঁত থাকুক, বাংলা রোমাঞ্চের যেকোনো পাঠককে তাই তার পাঠকজীবনে একবার হলেও নেমেসিসের পাতা ওল্টাতেই হবে।
গ্রন্থোল্লেখ:
[1] উদ্দিন, মোহাম্মদ নাজিম, দশম সংস্করণ এবং কিছু কথা (জুলাই, ২০১৮), নেমেসিস, ১০ম সংস্করণ: জুলাই ২০১৮, বাতিঘর প্রকাশনী;
[2] উদ্দিন, মোহাম্মদ নাজিম, সপ্তম সংস্করণ উপলক্ষ্যে কিছু কথা (নভেম্বর ২০১৫), নেমেসিস, ৯ম সংস্করণ: মে ২০১৭, বাতিঘর প্রকাশনী;
nemesis nazimuddin pdf book free download link: click here